আকুপ্রেশার থেরাপি সত্যিই কি কার্যকর? বিজ্ঞান কী বলে?


অলংকরণ: চ্যাটজিপিটি



আকুপ্রেশার থেরাপি হল একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি মূলত চীনা চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়। এতে শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্ট বা অঞ্চলে চাপ প্রয়োগ করে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা উপশম করার চেষ্টা করা হয়। আকুপ্রেশার অনেকটা আকুপাংচারের মতো, তবে এখানে সূচের বদলে আঙ্গুল বা বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।




কিন্তু প্রশ্ন হলো, আকুপ্রেশার সত্যিই কাজ করে কি না এবং আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে কী বলে? চলুন, সহজ ভাষায় এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা যাক।


আকুপ্রেশার থেরাপির মূল ভিত্তি হলো ‘চি’ বা জীবনীশক্তি। প্রাচীন চীনা বিশ্বাস অনুযায়ী, মানবদেহে কিছু বিশেষ মেরিডিয়ান বা শক্তির পথ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে চি প্রবাহিত হয়। যদি এই শক্তি পথগুলিতে কোনো বাধা সৃষ্টি হয়, তাহলে শরীরের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়।




বিভিন্ন অসুস্থতার কারণ হতে পারে। আকুপ্রেশার পদ্ধতিতে শরীরের নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করে সেই বাধাগুলো মুক্ত করা হয় এবং চি'র স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়।



আকুপ্রেশার মূলত হাতের আঙুল, কনুই বা বিশেষ কিছু যন্ত্র ব্যবহার করে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে চাপ প্রয়োগ করা হয়। এই নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোকে একিউপয়েন্টসবলা হয়।




এই পয়েন্টগুলির মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই পয়েন্টগুলিতে চাপ প্রয়োগ করলে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে, পেশীর টান কমে যায় এবং শরীরের সঠিক ভারসাম্য বজায় থাকে বলে মনে করা হয়।


আকুপ্রেশার থেরাপির মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যা উপশম করার দাবি করা হয়, যেমন: ব্যথা উপশম করা (মাথাব্যথা, পিঠের ব্যথা, গাঁটের ব্যথা), মানসিক চাপ কমানো, হজমের সমস্যা সমাধান, নিদ্রাহীনতা দূর করা, পিরিয়ডের ব্যথা উপশম, গর্ভাবস্থায় কিছু সাধারণ সমস্যার সমাধান ইত্যাদি।


বিজ্ঞান কী বলে?


আকুপ্রেশার নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে, তবে এর কার্যকারিতা নিয়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু গবেষণা আকুপ্রেশারের কিছু ইতিবাচক প্রভাব খুঁজে পেয়েছে, বিশেষ করে ব্যথা উপশম এবং মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে।




আবার অনেক গবেষণায় এর কার্যকারিতার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।


কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দিয়েছে যে আকুপ্রেশার কিছু ধরনের ব্যথা, যেমন মাইগ্রেন বা পিঠের ব্যথা উপশম করতে সহায়ক হতে পারে। ২০১১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আকুপ্রেশার থেরাপি নিতম্বের ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে এবং কিছু লোকের মধ্যে এটি নিতম্বের সমস্যার জন্য বিকল্প থেরাপি হিসেবে কার্যকর হতে পারে।


আকুপ্রেশারের প্রয়োগ নিদ্রাহীনতা বা মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে। কিছু গবেষণা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ করা হলে তা স্নায়ুতন্ত্রকে শিথিল করতে সাহায্য করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। এর ফলে মানসিক চাপ কমে এবং ঘুমের মান বৃদ্ধি পায়। তবে, এই ফলাফল সবক্ষেত্রে একেবারে নির্দিষ্ট নয় এবং এর কার্যকারিতা ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে।



আকুপ্রেশারের মাধ্যমে হজমের সমস্যা উপশম করা যায় বলে দাবি করা হলেও, এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুবই সীমিত। গর্ভাবস্থার সাধারণ সমস্যাগুলোর (যেমন বমি বমি ভাব) ক্ষেত্রে কিছু গবেষণায় আকুপ্রেশারের ইতিবাচক প্রভাব পাওয়া গেছে। তবে, এটি নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং থেরাপির সঠিক প্রয়োগের উপর।


 


প্লাসিবো ইফেক্টের সম্ভাবনা


অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আকুপ্রেশার থেরাপি অনেকাংশে ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। প্লাসিবো ইফেক্ট কী জিনিস? কোনো রোগ খুব মারাত্মক নয় এবং সেগুলোর সঙ্গে মানসিক ব্যাপার জড়িত থাকে। সে সব রোগের ক্ষেত্রে রোগির চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধের ওপর আস্থা থাকা জরুরি। এ ধরনের রোগের ক্ষেতে দেখা যায়, একটা ক্যাপসুলের ভেতর থেকে সব ওষুধ বের করে শুধু ক্যাপসুলের ওপরের ক্যাপটা খাইয়ে দেওয়া হয়, তাহলে রোগি সুস্থ হয়ে ওঠেন। স্রেফ ওষুধের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কারণে। এই ব্যাপারটাকে বলে প্লাসিবো ইফেক্ট। যদিও ওই চিকিৎসার সরাসরি কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, অনেক সময় আকুপ্রেশারের উপকারিতার পেছনে শুধুমাত্র মানসিক প্রভাবও থাকতে পারে।


আকুপ্রেশার সাধারণত ঝুঁকিমুক্ত থেরাপি হিসেবে পরিচিত, তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশেষ করে যদি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার না হয়ে অন্য কেউ এ চিকিৎসা করতে যান, তাহলে ভুল পয়েন্টে বা ভুল পদ্ধতিতে চাপ প্রয়োগ করলে ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া, গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে আকুপ্রেশারকে চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করা উচিত নয়, বরং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।



আকুপ্রেশার থেরাপি কয়েক হাজার বছরের পুরনো এবং অনেকেই এর উপকারিতা অনুভব করেন। বিশেষ করে ব্যথা উপশম, মানসিক চাপ কমানো এবং ঘুমের মান উন্নত করার ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে এর কার্যকারিতা পুরোপুরি প্রমাণিত নয়, এবং এর উপকারিতা প্রায়ই ব্যক্তি বিশেষে ভিন্ন হতে পারে। তাই, আকুপ্রেশার থেরাপি গ্রহণের আগে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদারের পরামর্শ নেওয়া এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চলা সবসময় বুদ্ধিমানের কাজ।




সূত্র: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ



Post a Comment

0 Comments